করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্ব বিপর্যস্ত। সকল দেশের অর্থনীতিকেই ধাক্কা দিয়েছে এই মহামারী। দেশের অভিবাসন খাতেও পড়েছে এর ভয়াবহ প্রভাব। সমগ্র বিশ্ব যখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে তখন প্রায় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি লড়ছেন জীবিকা বাঁচাতে।
বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী থাকলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের থাবায় মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর কোথাও বাংলাদেশিরা কার্যত ভালো নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বাংলাদেশি কর্মীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য নিয়ে চলতে হচ্ছে। অনেকে দেশে ফিরেছেন, আরো অনেকে ফেরার সুযোগ খুঁজছেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নিলেও কোথাও কর্মচাঞ্চল্য ফেরেনি। সর্বত্র এখনো ধাওয়া করছে করোনা, থামেনি মৃত্যুর মিছিল।
গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত বিদেশ থেকে ফিরেছেন প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি। এর মধ্যে শুধু মার্চ মাসে দেশে ফেরা দুই লাখ শ্রমিকের মধ্যে লক্ষাধিকই চাকরিচ্যুত। করোনা বিধ্বস্ত বিশ্বে নিজ দেশের মানুষই যেখানে ঠিকমতো কাজে ফিরতে পারছে না সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যে ধরনের কাজ করেন তাতে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। এদিকে বৈধ অভিবাসীরাই যেখানে কষ্টে আছেন; সেখানে অবৈধ বাংলাদেশিরা রীতিমতো মানবেতর সময় পার করছেন। এ অবস্থায় বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এখন টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। রেমিটেন্সের ভবিষ্যৎ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানান, সৌদি আরবসহ তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আগের মতো ভবিষ্যতে আর নাও থাকতে পারে। তাই শ্রমিকদের বিকল্প শ্রমবাজারে পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তারা। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম পড়ে গেছে। এতে অনেক দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কমে যাবে। তখন যাতে শ্রমিকরা অন্য দেশে যেতে পারেন সে জন্য অন্যান্য দেশে সুযোগ খুঁজছি-তাদের কোথায় পাঠানো যেতে পারে, সে চেষ্টা চলছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, যারা ইতোমধ্যেই এসেছেন ও সামনে আসবেন তাদের জন্যও সরকারের দিক থেকে নেয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। যাতে তারা কর্মক্ষম থাকতে পারেন সে জন্য ঋণ দেয়া হবে। স্কিল ট্রেনিং দেব, যাতে নিজেরা কাজ পান বা উদ্যোক্তা হতে পারেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটিএ) মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বলেছেন, এমনিতেই প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে কর্মী বিদেশে যাওয়া-আসা করে থাকে। কর্মী হিসেবে গেলেও আসার সময় কারা আসছে তা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ অবস্থায় বৈশ্বিক দুর্যোগ কবে শেষ হবে তা বলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশি কর্মীরা বেশিরভাগই বিদেশে নিম্নমানের কাজ করেন। যার প্রয়োজন সবসময়ই থাকবে। এরপরও যারা ফিরতে বাধ্য হবেন, তারা যাতে দেশে কাজ করে চলতে পারেন সরকার তাদের আর্থিক সহায়তা দেবে। এ নিয়ে কাজ চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, লোক যেমন ফিরবে তেমনিভাবে নতুন কর্মীও যাবে।
জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা সবমিলিয়ে প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ। করোনার ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, লেবানন, ইরাক, জর্ডান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আশিয়ানভুক্ত দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের ইতালি, স্পেন, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রুনাই, সুইডেন, লিবিয়ার শ্রমবাজারে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে।
সৌদি আরব থেকে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক ফেরত পাঠানোর খবর ডালপালা ছড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে দেড় লাখ বাংলাদেশি কর্মীর ভিসা বাতিল করছে বলে চাউর হয়েছে। কুয়েতে অবৈধভাবে থাকা প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি আত্মসমর্পণ করে দেশে ফেরার প্রহর গুনছেন। এর মধ্যে অনাহারে সেখানে দুইজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। কুয়েত ও মালদ্বীপ থেকেও বাংলাদেশিরা দেশে ফিরছেন।
মালয়েশিয়ায় দুই বছরের জন্য যাওয়া কর্মীদেরও দেশে ফেরার সময় হয়েছে। এছাড়া সেখানকার অবৈধ প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি কিভাবে দেশে ফিরবেন তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। তারা যেমন দেশে কোনো টাকা পাঠাচ্ছেন না; তেমনিভাবে বিমানের টিকেট কেটে দেশে ফেরার মতো অবস্থায়ও নেই তারা। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় বন্ধ শ্রমবাজার খোলার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা ঝুলে গেছে। থমকে গেছে দুই লাখ কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ। আবার মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অনলাইনে প্রায় এক লাখ ভিসা প্রক্রিয়াধীন ছিল। করোনার কারণে গোটা বিশ্ব লকডাউনে পড়ায় ৯০ দিন মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সেসব ভিসা এখন বাতিল হওয়ার উপক্রম। এরমধ্যে বিদেশে কর্মী পাঠাতে যদি সিন্ডিকেট ফের জেঁকে বসে তবে বিদেশে শ্রমবাজার যে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে তাতে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, চেইনশপ, পণ্যের দোকান, বার, নাইট ক্লাব সবকিছু বন্ধ থাকার পর এখনো সেসব স্থানে প্রাণ ফেরেনি। ওইসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের বড় অংশ কাজ করেন। এছাড়া হকার বিচরণও নিষিদ্ধ রয়েছে। গৃহকর্মীদের অনেকেই বেকার হয়েছেন। অজানা আতঙ্কে চাহিদা নেই কর্মীর।
এদিকে ইতালিতে ২ লাখ ৬০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। এর মধ্যে ৭৫ হাজার অবৈধ। অবৈধভাবে যারা আছেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসার (ভ্রাম্যমাণ) সঙ্গে জড়িত। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় বৈধভাবে থাকা অনেক বাংলাদেশিও সেখানকার পর্যটক অঞ্চলগুলোয় হকারি করেন। সব মিলিয়ে কমপক্ষে দেড় লাখ বাংলাদেশি ইতালিতে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পর্যটকরা আসা বন্ধ, ইতালিয়ানরাও প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে তেমন বের হন না। ফলে হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ভ্রাম্যমান ব্যবসা করা অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি। সৌদি আরবে রয়েছে ২২ লাখ বাংলাদেশি। যারা বিভিন্ন দোকান, রেস্তোরাঁ ও সবজি ক্ষেতে কাজ করেন। তারা এখন বেকার। এদের একটি বড় অংশ দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন ১০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি। কাতারে রয়েছে ৪ লাখ এবং কুয়েতে সাড়ে ৩ লাখ বাংলাদেশি। ব্রুনাইয়ের ৫০ হাজার, পর্তুগালে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশির প্রায় সবাই বেকার। তাদের ভবিষ্যত আশা নিরাশার দোলাচলে। এদের অনেকে এখন নানাভাবে সাহায্য নিয়ে চলছেন। যদিও বাংলাদেশ সরকার দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাহায্য করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
প্রবাসী-বেকারদের ঋণ দিতে ২৫শ’ কোটি টাকার তহবিল
ঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে ৫শ’ কোটি ও কর্মসংস্থানকে আরও দুহাজার কোটি টাকার আমানত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ আরও বাড়ানোর জন্য আরও ২ হাজার কোটি টাকা আমানত দেওয়া হবে। আমাদের যুবক শ্রেণি যাতে বেকার হয়ে ঘুরে না বেড়ায় তার জন্য তারা সেখান থেকে ঋণ নিতে পারবে। নিজেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। অথবা যৌথভাবে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবে। প্রবাসীদের জন্য ঋণ সুবিধা বাড়াতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের আমানত বাড়ানো হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন প্রবাসে কাজের পরিধি সীমিত হয়ে গেছে। সেখানে বহু মানুষ কাজ হারাচ্ছে, অনেকে দেশে ফিরে আসছে। তারা আমার দেশের নাগরিক, তারা সেখানে কষ্ট করুক তা আমরা চাই না।
ফিরে এসে এখানেও যাতে কিছু কাজ করে খেতে পারে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, শিল্পায়নে তারা যাতে সুযোগটা পায় সে জন্য তাদের ওই ব্যাংকে আরও ৫শ’ কোটি টাকা আমরা দিয়ে দিচ্ছি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেছেন, এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। এই খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মনিরুছ সালেহীন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে জেল বা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে থাকা বন্দীদের মুক্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে বেশ কিছু অবৈধ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
আমরা কূটনৈতিকভাবে বিষয়গুলো মোকাবেলা করে যাচ্ছি। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এত বিপুল সংখ্যক কর্মীকে দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে ওইসব দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা হচ্ছে। কোন কোন দেশের মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে সৌদি আরব এখন অনড় অবস্থানে রয়েছে। তারা বন্দীদের ও অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠাবেই। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষকে মানবিক দৃষ্টি থেকে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এত খারাপ খবরের মধ্যে বাহরাইন সরকার বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দিয়েছে। তাদের বিভিন্ন চাকরিতে যোগদানের সুযোগ করেছে। তারা কোন কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠাবে না। অন্য আরেকটি ভাল খবর দীর্ঘদিন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্যুরিস্ট ভিসা ছাড়া আর সব ধরনের ভিসাই বন্ধ ছিল। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য আবার ভিসা চালু করেছে।
চাকরিচ্যুত প্রবাসীদের পুনর্বাসন
জাতিসংঘ, ওআইসি ও ইইউকে বাংলাদেশের চিঠি

নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এমন প্রবাসীর সংখ্যাও কম নয়। চাকরিচ্যুত ও বিতাড়িত এসব প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের জন্য রেসপন্স ফান্ড বা সাড়া দান তহবিল গঠনে জাতিসংঘ, ইসলামিক দেশগুলোর জোট ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিশ্ব সংস্থাগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি লিখেছি। ওআইসির সঙ্গে আমরা টেলিকনফারেন্স করেছিলাম। তাদের আমরা বলেছি, তোমরা একটা রেসপন্স ফান্ড বা সাড়া দান তহবিল তৈরি করো। শুধু ওআইসিই নয়, আমরা ইইউকেও বলেছি। মোটামুটি কেউ এতে না করেনি। এখন এর মডেল তৈরি করতে হবে। আমরা জাতিসংঘকেও জানিয়েছি। আমরা তাদের বলেছি, যারা চাকরিচ্যুত হচ্ছে তারা সবাই মানুষ। সুতরাং তাদের হঠাৎ করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলো থেকেই বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হোক না কেন, সব দেশকে আরো মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সরকারকে জানিয়েছে, এসব প্রবাসী আপনাদের উন্নয়ন অংশীদার। এসব দেশের উন্নয়নের জন্য এ মানুষগুলো দিনের পর দিন খেটেছে। বাংলাদেশ এ দেশগুলো থেকে দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছে। প্রথমটি হলো, কোনো প্রবাসী যাতে এ পরিস্থিতিতে না খেয়ে মারা না যায়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের যদি চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়, তবে অন্তত পক্ষে ছয় মাসের জন্য যেন তাদের ধারণ করে। হঠাৎ করে তাদের বের করে দিলে তারা ঝামেলায় পড়বে। বাংলাদেশের এ অনুরোধে কোনো কোনো রাষ্ট্র ইতিবাচকভাবে নিয়ে সাড়া দিয়েছে। কয়েকটি রাষ্ট্র আশ্বস্ত করেছে, প্রবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা ও খাবারের জন্য বাংলাদেশের চিন্তা করতে হবে না। সেই সঙ্গে এসব বাংলাদেশি যাতে রেমিটেন্স দেশে প্রেরণ করতে পারে, সেজন্য তাদের অর্থ দিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দেশগুলো।
ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশফেরত প্রবাসীদের পাশে আইওএম
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহ থেকে ফেরত আসা বিপদাপন্ন প্রবাসীদের তাৎক্ষণিক, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রদান করছে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ২০২০ সালে কয়েক লাখ প্রবাসীদের ফেরত আনা, গ্রহণ এবং পুনরেকত্রীকরণে সরকারকে সহায়তাও করছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বাস্তবায়নকারী সহযোগী সংস্থা বাংলাদশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্র্যাক) ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন দেশসমূহ থেকে ফেরত আসা বিপদাপন্ন প্রবাসীদের সহায়তা প্রদানে কাজ করছে। সংস্থাটি একই সাথে বিপদগ্রস্ত প্রবাসী, বিশেষ করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) দেশসমূহ থেকে ফেরত আসা প্রবাসীদের সহায়তার জন্য অতিরিক্ত অর্থায়ন নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইউ) অর্থায়নে এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আইওএম বিদেশে আটকে থাকা অভিবাসী এবং ইইউ দেশফেরত বিপদাপন্ন প্রবাসীদের সহায়তা প্রদান করছে। আইওএম-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রবাসীদের জন্য একটি হটলাইন (+৮৮০৯৬১০১০২০৩০) খোলা হয়েছে। হটলাইনে কলদাতাদের সহায়তা এবং কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
মার্চ ২০২০ থেকে ইউ-এর অর্থায়নে পরিচালিত ১০টি পুনরেকত্রীকরণ সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে ৮০৬ জন ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশ ফেরত প্রবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা এই সেবাকেন্দ্রসমূহের আওতাভুক্ত। এদের মধ্যে বিপদাপন্ন প্রবাসীদের চিহ্নিত করে তাদের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা হয় এবং চলাচলে বিধিনিষেধ, বেকারত্ব এবং ঋণের মত এই মহামারি সৃষ্ট বিরূপ প্রভাব কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয়েছে।
এরপর প্রয়োজনীয়তা এবং বিপদাপন্নতা মূল্যায়ন করে বিদেশ ফেরত এসব প্রবাসীদের তাৎক্ষণিক নগদ সহায়তা, দীর্ঘমেয়াদি পুনরেকত্রীকরণ সহায়তা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা প্রদান করা হবে। এই সহযোগিতা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটের মত অভিঘাতমূলক ঘটনায় সংকটাপন্ন প্রবাসীদের মাঝে সহনশীলতা তৈরী করবে।
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজি টেরিংক বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদে, বিশেষ করে প্রবাসীসহ সর্বোচ্চ বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর উপর এই মহামারির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সরকারদের সহায়তা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রস্তুত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে প্রত্যাশা প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসা অভিবাসীদের সহায়তায় কাজ করছি আমরা, যেন করোনাভাইরাস-পরবর্তী বাস্তবতায় সমাজে নিজেকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তাদের কাছে থাকে। আইওএম বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান গিওরগি গিগাওরি বলেন, বিভিন্ন দেশ বিধিনিষেধ শিথিল করলে এবং বিমানসংস্থাগুলো পুনরায় ফ্লাইট চালু করলে হাজার হাজার অভিবাসী বাংলাদেশে ফিরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের মাঝে অনেক প্রবাসীর জন্যই এই স্বদেশ ফেরত সুখকর হবে না কারণ অনেকেই করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে জীবিকা হারিয়েছেন।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব থেকে বৈশ্বিক শ্রমবাজার পুনরায় ঘুরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত তাদের বিদেশে কাজে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় এই যে, এই প্রবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদাপন্নদের তাদের খাবার, আশ্রয়, মনোসামাজিক এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চাহিদা মেটাতে তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। একইসাথে তাদের সহনশীলতা তৈরিতে ও টেকসই পুনরেকত্রীকরণ নিশ্চিতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে তাদের ঋণ মধ্যস্থতা সংক্রান্ত সহায়তা প্রয়োজন হবে। দরকার হবে জীবিকা নির্বাহের সহযোগিতা।
করোনায় শ্রমবাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তবে কি পরিমাণ পড়বে সেটা নির্ভর করবে আমাদের পলিসির জায়গায়। এই পরিস্থিতিতে বাজারগুলো বন্ধ হবে। কিন্তু এটাও ঠিক, করোনা উত্তর বিশ্বে নতুন বাজার তৈরি হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য এবং ক্লিনিং সেক্টরে। স্বাস্থ্য সেক্টরে মেজর একটা ওপেনিং হবে, কারণ প্রতিটি দেশই এখন ম্যাসিভ ইনভেস্টমেন্ট করবে এই সেক্টরে। সেক্ষেত্রে ল্যাব টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে আমরা যদি ওই ধরনের জিনিসপত্র বানাতে পারি তাহলে কর্মসংস্থান হবে। এক্ষেত্রে এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। নার্র্সিং এডুকেশনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্য করতে হবে। এটা করতে পারলে আমরা যে ভয় পাচ্ছি, সে ভয় কেটে যাবে। ওইসব দেশে যারা চাকরি করেন, তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকে। তারা যেন সেগুলো ঠিকঠাক পায়,সেজন্য সরকারকে ভূমিকা পালন করতে হবে। বিষয়গুলো বহুপাক্ষিক ফোরামে তুলতে হবে। এখন থেকে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে, যেন ফেরত পাঠানোর সময় সেগুলো পায়।
চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে সামর্থ্যের প্রায় সবটুকুর বিনিময়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি। তারাই এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। শূন্য চোখে নিজের আর প্রিয়জনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার আভাস। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যেই প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে উঠবে বিশ্বের অনেক দেশ। এরপরই জনশক্তি আমদানি করবে তারা। তবে এর মধ্যে যদি বাংলাদেশ করোনামুক্ত না হয়, তবে সেই সুযোগ কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে।
দুর্যোগের মুখে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে বহুপাক্ষিক ফোরামে তা উপস্থাপনের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিট চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশ সরকারের এখন উচিত জরুরিভাবে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোকে এই ইস্যুটা তুলে ধরা। সংকট কাটাতে সরকার ও সচেতন মহলের সমন্বিত উদ্যোগ আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিঙ্গাপুর সরকারের উদ্যোগে স্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশি কর্মীরা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরা তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছেন। সিঙ্গাপুর সরকার সর্বোতভাবে তাদের সহায়তা করছেন। যদিও সেখানকার ৯০ শতাংশ শ্রমিক বিভিন্ন ডরমেটরিতে থাকায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। তাদের চিকিৎসায় স্থানীয় নাগরিকদের সমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এর অংশ হিসেবে আক্রান্ত প্রবাসী শ্রমিকদের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে মেরিনা বে’র মতো পাঁচতারকা হোটেলে, ব্যয়বহুল ইয়টগুলোতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরের বিলাসবহুল আবাসিক হোটেলগুলোকে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পাঁচতারকা মানের আরও কিছু হোটেল, যেমন-অরচার্ড, ক্লাক কোয়ারি ইত্যাদিতে প্রবাসী শ্রমিকদের রাখা হচ্ছে। জনশক্তি মন্ত্রণালয় অভিবাসী কর্মীদের যথাসময়ে বেতন প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করছে এবং যেসব কর্মীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তাদের নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ইলেকট্রিক পদ্ধতিতে বেতন প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে জনশক্তি মন্ত্রণালয় নিয়োগদাতাদের সঙ্গে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সার্কিট ব্রেকার শুরুর আগে ৪ লাখ ৭২ হাজার শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল আর এখন ৫ লাখ ২১ হাজার শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপে অভিবাসীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে।
প্রবাসী কর্মীদের করোনা মোকাবেলায় সিঙ্গাপুর সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপগুলো প্রশংসিত হয়েছে সারা বিশ্বে। বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি হি শিয়েন লুঙ এর সাথে ফোনে কথা বলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এক লক্ষ বিশ হাজারের মতো বাংলাদেশের শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানোতে সিঙ্গাপুর সরকারের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সিঙ্গাপুর সরকারের প্রতি।